প্রবাসীদের ঘামের টাকা, সচল রাখে দেশের চাকা। ‘প্রবাসী’ শুনলে অজান্তেই মনের ভিতর গভীর শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। যাদের কষ্টার্জিত রক্ত পানি করা অর্থে দেশের মরিচা ধরা চাকা নতুন করে চলার শক্তি পায়, যাদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভিত্তি করে অর্থনীতির ভিত দণ্ডায়মান, যারা নিজের সুখ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটান তারাই প্রবাসী। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। সামপ্রতিক সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের মহাসড়কে যাত্রা করেছি আমরা। আর এই সাফল্যের পেছনে সিংহভাগ ভূমিকা পালন করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। অথচ আমাদের প্রবাসীরাই এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আজ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, নির্যাতিত। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা যতটা না বেশি শঙ্কিত, তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত বাংলাদেশি হয়ে। অনেক প্রবাসীকেই আক্ষেপ করতে দেখা যায় এটা বলে যে, শুধু বাঙালি হওয়ার কারণে তাদের শ্রমের মূল্য কম। কর্মক্ষেত্রে তাদের ততটা প্রাধান্য দেওয়া হয় না, যতটা পাকিস্তান কিংবা ভারতীয় প্রবাসীরা পান। তাহলে এর জন্য কি শুধু তাদের অদক্ষতাই দায়ী? নাকি আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা দূতাবাসগুলোরও দায়িত্বে হেরফের হচ্ছে কোথাও?
মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়া হাজার হাজার নারীশ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন। যাদের বেশিরভাগই শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার। অন্যদিকে এমনটাও দেখা যায়, যেখানে অনেক শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে দেশে ফেরত আসেন। যার ফলে তারা মোটা অঙ্কের ক্ষতির মুখোমুখি হন। কেননা তাদের বেশিরভাগই সহায় সম্বল বিক্রি করে বা চক্রবৃদ্ধি সুদে জীবিকার তাগিদে দূরদেশে পাড়ি জমান। এখন যদি প্রতিনিয়ত আমাদের প্রবাসীদের এমন দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতির চাকা মন্থর হয়ে পড়বে। মানুষ বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। যার ভয়াবহতা হবে খুবই বিপজ্জনক। কিছুদিন আগে প্রবাসীদের আয়ের ওপর ভ্যাট বসানোর ব্যাপারে যে গুজব ছড়িয়েছে তা যদি বাস্তবে ঘটে, তবে তা হবে মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মতো। তাছাড়া এমন হলে দেশে হুন্ডি ব্যবসার প্রবণতা বাড়বে এবং দেশের ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যাদের দ্বারা দেশের ভিত মজবুত অবস্থানে রয়েছে তাদের কষ্ট লাঘব করা এখন আমাদের দায়িত্ববোধের বিষয়। সরকারকে প্রবাসীদের ব্যাপারে আরো ভাবতে হবে। তাদের কষ্ট লাঘবে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন জরুরি। দূতাবাসগুলোকে আরো বন্ধুসুলভ হতে হবে। প্রবাসীদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত। প্রবাসের অনেক হিসাব-নিকাশই তাদের অজানা। যার কারণে বছরের পর বছর তারা নির্যাতিত হয় মালিকশ্রেণি দ্বারা। বাধ্য হয়েই তাদের হতে হয় অবৈধ অধিবাসী এবং মেনে নিতে হয় প্রবাসের কারাবাসকে। দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীরা যেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা পায় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। বাঙালি হয়ে তাদের যেন আক্ষেপ না করতে হয়, নির্যাতিত না হতে হয় সেজন্য সজাগ হওয়া প্রয়োজন। দক্ষ শ্রমিক গঠনে বিদেশ যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এক একজন প্রবাসী এক একজন মানব সমপদে পরিণত হয়। অন্যথায় দেশে বেকার সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। পরিণামে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ব আমরা।